সকালে ঘুম থেকে উঠেই বমি
করে ফেলার মধ্যে অদ্ভুত একটা সারল্য থাকে ।কেমন হড়হড় করে উগরে দেয়া যায় গত রাতের
ক্লেশ ।সাত ফুট বাই সাত ফুটের এই অলৌকিক বাথরুমের মধ্যেও হাসি পায় ।ভেজা দেয়ালে এক
হাতে ভর দিয়ে, সামান্য ঝুঁকে রাজুমিহিন
হাসে । অপাচিত খাদ্যকনা , বাংলার টকসাটে
গন্ধের ভেতর হাবুডুবু খেতে খেতে বালতি , মগ , কোমোড ঠকঠক করে ওঠে ।
রোদের ফালি ঢুকে একটা হ্যাল ওয়েদার । এই ভোরবেলা রাজুমিহিন বমি করে ফেলেছে ,
রক্তবমি নয় , নিতান্তই সাধারণ ওয়াক ওয়াক । এই রকম অপরাধবোধে রাজুমিহিন জল
ঢেলে দেয় , ঝাঁটার কাঠি দিয়ে নর্দমা
সাফ করার সময় বার কয়েক থুতু ফেলে । এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে । এমনকি হিসি করার পর
ফোরস্কিনটা নিয়ে একটু আধটু নাড়াচাড়াও করে সে । এমনকি বাথ্রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর
ছিটকিনি তুলতেও ভোলেনা ।
একটা উইলস ফ্লেক ধরানোর পর কাপ্তানি ফিরে আসার কথা । আমাকে কি
এখন জিসাস ক্রাইস্টের মত দেখাচ্ছে ? ভাবে সে । কল্পনাকে কাল ওভাবে বলাটা ঠিক হয়নি । সবার সামনে চেঁচিয়ে বলা উচিত
হয়নি , আই অ্যাম নট জিসাস
ক্রাইস্ট । যতই হোক, কল্পনার তো একটা মান
সম্মান আছে , আর সেটা আমার থেকে অনেক
মজবুত । অবশ্য কল্পনা এর থেকে কম কিই বা আশা করেছিল । রাজুমিহিন তো
আর ফেকবার মত ত্যানা নয় ।
ধোঁয়ার রোলটা আস্তে করে উগরে দেয় , আলজিভ দিয়ে ঠোকর মারতে থাকে । এই রিং করাটা সবথেকে ভাল পারত
মৌ । বাজি রাখত । দশ টাকা ফ্যাল , পরপর পাঁচটা রিং
বার করে দেখিয়ে দিচ্ছি । পার রিং দুটাকা দিতে জ্বলত না , কেবলমাত্র মৌএর পাতলা ঠোঁটের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার
প্রণামী হিসেবে ।
আমার এখন ফ্রেস লাগার কথা । কিন্তু তেমনটা লাগছে না কেন ?
সিগারেট খাবার পর গলাটা শুকিয়ে গ্যাল ।
ফ্রেসনেসের থেকে আকাঙ্খিত জিনিস আর কিই বা আছে । রাজুমিহিন ভাবে । ব্রাশ করার পর বা একটু ঘুমিয়ে ওঠার পর বা একটু বৃষ্টির পরকার সতেজ হাওয়ার
অনুভুতিই আলাদা । খিদে লাগছে বেশ । পেটের ভেতরটা কুঁচকে উঠছে মাঝে মাঝে ।
রাজুমিহিন এদিকওদিক তাকায় ।
ঘরে কিস্যু নেই । কালকের
তরকারির একটু বাকি আছে বটে । কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি তো ? ঢাকা খুলে গন্ধ শোঁকে । না , ঠিকই আছে । জাস্ট গরম করতে হবে । কাদা কাদা আলুরদম ,
একটু জল আর গরম মসলা দিয়ে গরম করলেই ফার্স্টক্লাস
। আঃ ,রাজুমিহিন টাকরায়
একটা চমৎকার শব্দ করে । গলার কাছটায় একটা অস্বস্তি থম মেরে বসে আছে ।
গলা দিয়ে আলুর পিণ্ডটা
নামার সময় তার খেয়াল হল , আজ ১৩ তারিখ ,
ইলেকশনের রেজাল্ট । ভাবল এতক্ষণে ফলপ্রকাশ
শুরুও হয়ে যাবার কথা । বেশ লাগে দেখতে । এখুনি আমাদের কাছে খবর এল অমুক জায়গা থেকে
তমুক দলের প্রার্থী তসুক এত হাজার ভোটে এগিয়ে আছেন । এ বিষয়ে জানতে আমরা সরাসরি
চলে যাব আমাদের নিজস্ব সম্বাদদাতা...এটসেটরা এটসেটরা । ভোটের রেজাল্ট জানার রাইট
ভোট দেবার মতই সার্বজনীন । আমাকে জানতেই হবে । রাজুমিহিন উত্তেজিত হয়ে ওঠার চেষ্টা
করে । কারণ এভাবেই সে ওই থমটাকে কাউন্টার করতে পারবে , এমত মনে হয় ।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়েই
পাশের বাড়ির জানলা । দুটো জানলা পরস্পরকে দেখার মধ্য দিয়ে একটা দারুণ সম্পর্ক হয় ।
বউদি আর তার শ্বশুর বসে বসে টিভি দেখছে ।
-বউদি কি খবর ? কে লিডিং ?
-বউদি সবুজ শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নেয় । হাসিহাসি মুখ
করে বলে , টিএমসি ।
কল্পনার নেচার যা তাতে আজ সকালেই ওর এখানে আসার কথা । একটা
টকটকে সালোয়ার পরে আসবে ও , চোখে মুখ ঢেকে রাখার মতো একটা
সানগ্লাস । কতবার রাজুমিহিন বলেছে ওই সানগ্লাস পরে আমার সামনে আসবি না । কল্পনা
ইগনোর করার ভঙ্গীতে সানগ্লাসটা ঠেলে মাথার ওপর সরিয়ে রাখবে । খাটে বসে ঢকঢক করে
সেভেনআপের বোতল থেকে জল খাবে । রাজুমিহিন লক্ষ্য করবে জল খাবার সময় কল্পনার
মুখভঙ্গিটা কেমন বিশ্রী লাগে , কেমন ওই চিবুকটা ,
মাছের পেটীর মতো চিবুকটা যান্ত্রিকভাবেওঠানামা
করে । রাজুমিহিন ওই দৃশ্যটাকে এড়ানোর জন্য
, শুধু সে কারণেই , মা কসম , প্রশ্ন করবে ,
অলোকদা কেমন আছে । এই যে নিজেকে বা নিজেদের বাদ
দিয়ে প্রশ্ন করার কৌশল সেটা কল্পনা ঠিক ধরে ফেলবে এবং কোন উত্তর দেবে না ।
রাজুমিহিন এবার উঠে এসে কল্পনার ঘাড়ে হাত রাখবে । অল্প চুলের রোঁয়া রোঁয়া ।
ম্যাসাজ করার ঢঙে হাত চালাতে চালাতে বলবে , তাহলে একটা গান চালাই,টুকুন । কল্পনা কেঁদে ফেলবে অথবা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলবে ,
কাল সবার সামনে আমাকে ওইভাবে বললি কেন ?
রাজুমিহিন
তাক থেকে বেগম আখতারের একটা রেকর্ড বের করবে । গ্রামোফোনের পিনটা যথাযথ
স্থাপনের পর আর্তির মত বেজে উঠবে ...ফিরে যা , ফিরে যা বনে ।
একটি হত্যায় কিই বা এসে
যায় । হত্যা ও আত্মহত্যা স্বাধীনতারই ব্যাপার । রাজুমিহিন ভাবে । স্বাধীনতার
ডিগ্রিনির্ভর ।কল্পনা কি তাকে খুন করেনি ? হয়ত সে নিজেও জানে না , সে কবেই মরে
গ্যাছে । সুতরাং কল্পনার মৃত্যু কোন বিষয়ই হতে পারে না ।বিষয় হল প্রেম । সে তো
কল্পনাকে ভালই বাসে । আর কিছু তো এর থেকে তীব্র হতে পারে না ।
কল্পনা ক্রমশ নিজেকে মেলে ধরবে । কমলালেবুর কোয়া ছাড়ানোয় ।
বোতাম খোলার শব্দে । কল্পনার হাতে পড়ে সেক্স যেন শিল্প হয়ে ওঠে । রাজুমিহিনের ঘরের
আলো নরম হতে হতে কল্পনার ত্বকের সাথে এক অপূর্ব দ্রবণ । এর থেকে উৎকৃষ্ট সময় আর কি হতে পারে , ডিয়ার রাজুমিহিন
। "যাও , ক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য
উদ্ধার করিয়া আনো , উহাকে যাচাই কর ।
অন্তরলীন জ্ঞান থেকে আরম্ভ কর ,উহাকে সক্রিয়ভাবে যৌক্তিক জ্ঞানে পরিণত কর , আবার যৌক্তিক জ্ঞান থেকে শুরু করিয়া বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার
মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও বস্তুগত বিশ্বকে
পরিবর্তন করিবার প্রয়াস কর । ক্রিয়া , জ্ঞান , পুনরায় ক্রিয়া , এবং পুনরপি জ্ঞান । অনন্ত চক্রাকারে এইভাবে চলিতেছে ,
প্রতিটি স্তরেই ক্রিয়া ও জ্ঞান ক্রমশ উন্নীত
হইয়া উঠিতেছে । এই হল জ্ঞানের দ্বন্দ্বমূলক ও বস্তুবাদী তত্ত্ব । এই হল জ্ঞান ও
ক্রিয়ার অভেদ সম্পর্ক । "
কল্পনা কঁকিয়ে ওঠে । ও যেন এই ভার , এই শ্বাসরোধ আর সহ্য করে উঠতে পারবেই না । এমন ভান করে । ওই
শাদা গলায় রাজুমিহিন মুখ রেখেছে কতবার । কী পলকা , প্যাঁকাটির ভেতরকার শাঁসের মত নিরপরাধ । আর এখন তীব্র
যুযুধান । কল্পনারশরীর মুচড়ে কিছু ঘাম ওঠে । ঘামগুলি ক্রমে মেঘ হয়ে যায় । মেঘ থেকে
বৃষ্টি নামে । বড় মেদুর সে বৃষ্টি । দেয়ালগুলি গলতে শুরু করে । এত বছরের পুরনো চুনকাম , ঘেঁষাঘেঁষি আর অতিকথন সব বিগলিত হয়ে যেন বা প্লাবন আসে ।
ছোট্ট ওই ঘরে মোহাব্বতআর কতটুকুই বা আঁটে ! রাজুমিহিন প্রায় গলা অব্দি ডুবে যায় ।
এই ভাল হল । সমস্তটা ঘর গলে গিয়ে সমুদ্রের মত আর আমি অ্যাস ইফ হেঁটে হেঁটেই পারাপার করে ফেললাম । হাউ ফ্যাসিনেটিং !
রাজুমিহিন দিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার হেসে ফেলে । এখন আমাকে নিশ্চয়ই জিসাসের মত দেখাচ্ছে ।